পরিবেশ অধিদপ্তর: সরষের মধ্যেই ভূত

দূষণ ও পরিবেশগত ঝুঁকির কারণে বিশ্বে যেসব দেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত তার মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ। মানুষের অসচেতনতা ও অনিয়ন্ত্রিত আচরণের কারণেই পরিবেশ দূষণ হচ্ছে। হুমকির মুখে পড়ছে জীববৈচিত্র্য। এমন পরিস্থিতিতে পরিবেশ অধিদপ্তরের সক্রিয় ভূমিকা রাখার কথা। অথচ নিয়মবহির্ভূতভাবে অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে শিল্প-কারখানার ছাড়পত্র দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে সরকারের এ সংস্থাটির বিরুদ্ধে। উৎকোচ নিয়ে পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড জেনেও নিশ্চুপ থাকছেন অধিদপ্তরের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রাতিষ্ঠানিক টিমের অনুসন্ধান এবং ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) করা এক গবেষণা প্রতিবেদনেও এমন চিত্র উঠে এসেছে।

পরিবেশ দূষণ রোধে দূষণকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ক্ষতিপূরণ ধার্যের আইন রয়েছে। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী অধিদপ্তরটির এনফোর্সমেন্ট বিভাগ সেই ক্ষতিপূরণ ধার্য করে থাকে। তবে দুর্বল এনফোর্সমেন্ট ও আইনের ফাঁক গলে পার পেয়ে যাচ্ছেন দূষণকারীরা। সবচেয়ে উদ্বেগজনক তথ্য হলো, অবৈধ অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে অবৈধ কাজে সহায়তা, এমনকি আইনের ফাঁকফোকর দেখিয়ে দেন পরিবেশ অধিদপ্তরের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারাই। পরিবেশ দূষণকারী শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকদের সঙ্গে সংস্থাটির কর্মীদের একাংশের যোগসাজশের কারণে বড় অংশই পার পেয়ে যাচ্ছেন। যাদের এনফোর্সমেন্ট করে ক্ষতিপূরণ ধার্য করা হচ্ছে, তারাও যথাযথভাবে ক্ষতিপূরণ দিচ্ছেন না।

পরিবেশ অধিদপ্তরের এনফোর্সমেন্ট ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সংস্থাটি ২০১০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত মোট ১২ হাজার ৫৩০টি প্রতিষ্ঠানকে ক্ষতিপূরণ ধার্য করেছে। এই সময়ের মধ্যে ধার্যকৃত অর্থের  পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫০৪ কোটি টাকা। যার মধ্যে আদায় হয়েছে মাত্র ২৪১ কোটি টাকা। অর্থাৎ ধার্যকৃত ক্ষতিপূরণের অর্ধেকই আদায় করতে পারেনি সংস্থাটি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্বল এনফোর্সমেন্ট ও আপিলের সুযোগ নিয়ে দূষণকারীরা আরও বেশি দূষণে উৎসাহিত হচ্ছে। এ জন্য অবশ্যই পরিবেশ অধিদপ্তরের এনফোর্সমেন্ট বিভাগ ও মন্ত্রণালয়ের সদিচ্ছার অভাবকে দায়ী করছেন তারা। 

আইনের শাসন, সক্ষমতা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, অংশগ্রহণ, কার্যসম্পাদন, সমন্বয় ও অনিয়ম-দুর্নীতি- এ আটটি সূচকের আলোকে গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়। গবেষণায় উঠে এসেছে, মেয়াদোত্তীর্ণ ছাড়পত্র দিয়ে কার্যক্রম চালাচ্ছে ৫১ শতাংশ শিল্প-কারখানা, যার ৭০ শতাংশ আবার তথ্য সংগ্রহের সময় পর্যন্ত নবায়নের জন্য আবেদনই করেনি। জরিপের আওতাভুক্ত প্রায় ৭২ শতাংশ শিল্প-কারখানাই আবাসিক এলাকায় অবস্থিত। এদের ১৭ শতাংশ স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনাপত্তিপত্র না পাওয়া সত্ত্বেও পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে ছাড়পত্র পেয়েছে। ক্ষমতার অপব্যবহার ও ক্ষেত্রবিশেষে অবৈধভাবে অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে এটি করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া দূষণকারীদের বিরুদ্ধে পরিবেশ আদালতে মামলা করার পরিবর্তে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনায় অধিদপ্তর বেশি আগ্রহী বলে অভিযোগ রয়েছে। আবার পরিবেশগত ছাড়পত্র পেতে ৬৬ শতাংশ শিল্প-কারখানাকেই নিয়মবহির্ভূতভাবে অতিরিক্ত টাকা দিতে হয়। 

পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের তাই অভিমত, পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা পালনে পরিবেশ অধিদপ্তর ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। উলটো পরিবেশ অধিদপ্তরের কারণে পরিবেশ দূষণ আরও বাড়ছে, সরষের মধ্যেই ভূত থাকলে যা হয়। গবেষণা প্রতিবেদনে তাই বলা হয়, পরিবেশ অধিদপ্তর বায়ুদূষণ বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছে। এটি দুর্বল, দুর্নীতিগ্রস্ত এবং অনেকাংশে অক্ষম ও অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের সূত্র মতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২৬৭১টি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ৩৬ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ ধার্য করে। আদায় করেছে ১৪ কোটি টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে ২ হাজার ১৫৭টি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ৫১ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ ধার্য করে। আদায় করেছে ১৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ক্ষতিপূরণের অর্ধেকও আদায় করতে পারছে না সংস্থাটি। মূলত দূষণকারীরা মন্ত্রণালয়ে আপিল করে ক্ষতিপূরণের অর্থ কমিয়ে ফেলে। 

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘সরকার আমাদের শুধু উন্নয়নের গল্প বলে, পরিবেশের কোনো কথা তো আমরা শুনি না। তাই পরিবেশের উন্নতির জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা সবার আগে প্রয়োজন।’

ক্ষতিপূরণের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটা শুধু পরিবেশ অধিদপ্তর নয় বরং আমি মনে করি পরিবেশ মন্ত্রণালয়েরও দুর্বলতা। বাংলাদেশে যে পরিমাণ পরিবেশের ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে এবং হচ্ছে এর বিপরীতে ক্ষতিপূরণ ধার্য অনেক বেশি হওয়ার কথা। অন্তত বাংলাদেশের বাজেটের সমপরিমাণ অঙ্ক তো হবেই। কিন্তু সেটা হয়েছে এক যুগে পাঁচশ কোটি টাকার বেশি মাত্র। তাও অর্ধেকই আদায় হয়নি। এগুলো আবার মন্ত্রণালয় থেকে আড়ালে-আবডালেই কমিয়ে ফেলে। পরিবেশ দূষণকারীরা ক্ষতিপূরণ ধার্যের পর আপিল করে সেটা একেবারে নামমাত্র অঙ্কে নিয়ে আসে। আমরা একটা আবাসন কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা করলে ৫০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ ধার্য করা হয়। পরে আপিল করে সেটা মাত্র ৫ লাখ টাকায় নিয়ে আসা হয়। তার মানে পরিবেশ দূষণ রোধে মন্ত্রণালয়ের কোনো সদিচ্ছা আছে বলে মনে হয় না।’ 

অন্যদিকে দুদকের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, তরল বর্জ পদার্থ পরিশোধনে বেশিরভাগ শিল্প প্রতিষ্ঠানে এফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (ইটিপি) না থাকলেও উৎকোচ নিয়ে ছাড়পত্র দিয়ে দেয় পরিবেশ অধিদপ্তর। ইটভাটা চালানোর জন্য লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রেও নিয়ম-নীতি মানেন না দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তারা। এ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের স্বেচ্ছাচারিতা ও দুর্নীতির কারণে নদ-নদী, খাল আরও বেশি দূষিত হচ্ছে। ক্রমে পরিবেশ পরিস্থিতি আরও অবনতির দিকে যাচ্ছে।

দেশের পরিবেশ দূষণ ধ্বংসাত্মক আকার ধারণের পেছনে পরিবেশ অধিদপ্তরের দুর্বল এনফোর্সমেন্ট দায়ী বলে মন্তব্য করেন রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের (আরডিআরসি) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ। পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি উল্লেখ করে এ বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘কোনো প্রতিষ্ঠান যদি পরিবেশ দূষণ করেছে প্রমাণ হয়, জরিমানা করার সঙ্গে সঙ্গে তাদের বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিতে হবে। পরিবেশ অধিদপ্তর আগে এটা করত। কিন্তু ইদানীং তারা এটা করছে না। ফলে দূষণকারী আপিল করে আবার দূষণ করতে থাকে। এ দুর্বল প্র্যাক্টিস থেকে পরিবেশ অধিদপ্তরের বেরিয়ে আসতে হবে।’

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের মনিটরিং অ্যান্ড এনফোর্সমেন্টের পরিচালক মোহাম্মাদ মাসুদ হাসান পাটোয়ারী বলেন, ‘ক্ষতিপূরণ ধার্যের একটি নীতিমালা আছে। এর বেশি বা কম ধার্যের সুযোগ নেই। আবার আপিল করাটাও আইনসম্মত বিষয়। আইন মেনেই এনফোর্সমেন্ট বিভাগ তার কাজ করে যাচ্ছে।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //